
মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ও বৃদ্ধাশ্রম
"ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে"
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই শিশুরাই। একজন বাবা মায়ের কাছে তার একমাত্র ভবিষ্যত বা স্বপ্ন হলো তার সন্তান। এই সন্তানরা যেন হাসি খুশিতে থাকে সেটাই সকল বাবা-মা তথা গুরুজনদের লক্ষ্য। একজন অসহায় গরিব বাবা-মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দেন। তারা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর জীবন সংগ্রাম করে অর্থ উপার্জন করেন, কারণ তাদের সন্তানরা যেন সুখে থাকেন। তারা তাদের সন্তানদের তাদের নিজের প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সবসময় তাদের সন্তানদের মাথার ছাদ হিসাবে বিরাজ করেন। সন্তানদের সুখেই তাদের সুখ ও সন্তানদের দুঃখেই তাদের দুঃখ।
বাবা-মায়েরা সন্তানদের কাছ থেকে অনেক স্বপ্ন দেখে থাকেন। তাদের সন্তানরা একজন ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন বা তারও বড়ো পদে যাবেন, তখন তাদের সংসারে আর কোন দুঃখ কষ্ট থাকবেনা। সকলে মিলে একই পরিবারে একসাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করবেন। এ জন্য সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ভালো ভালো শিক্ষকের কাছে টিউশন দেওয়া হয়। সেই টিউশনের খরচ যতই বেশি হোক না কেন, তাতে বাবা-মায়ের কোন কৃপনতা থাকে না।
ছাত্র-ছাত্রীরা যে পরিমান পাঠ্যপুস্তকের প্রথাগত শিক্ষার জ্ঞান অর্জন করে, সে পরিমান কিন্তু তারা নৈতিক শিক্ষা বা নীতিজ্ঞান অর্জন করতে পারে না। কেননা তাদের পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিক আদর্শ জ্ঞান প্রদান করা হয় না। এর ফলে তারা কেবল বর্হিজগতের বিদ্যা অর্জন করে কিন্তু নৈতিক আদর্শ বা শিক্ষা থেকে অজানাই থেকে যায়। তারা কেবল বিদ্যাবুদ্ধি নিয়েই ব্যাস্ত, তারা ভুলে যান সমাজের নৈতিক আদর্শবাদ।
প্রাচীন কালের জীবন চর্চায় আমরা চারটি বর্ণ বা চতুরাশ্রম লক্ষ্য করি- ব্রহ্মচর্য, গ্রার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্যাস। প্রাচীনকালের এসব প্রথা আজ আর দেখা যায়না ঠিকই কিন্তু একমাত্র একটি প্রথাই আমরা বর্তমান সমাজে লক্ষ্য করে থাকি সেটি হলো সন্যাস প্রথা। তবে এই সন্যাস প্রথা এখন নৈতিকতার উৎকর্ষের ফলে আধুনিক যুগে তার নতুন নাম পেয়েছে "বৃদ্ধাশ্রম” প্রথায়।
নৈতিকতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে এই সন্যাস প্রথা তথা বৃদ্ধাশ্রম প্রথারও কিছু কিছু সংস্করণও আমরা লক্ষ্য করে থাকি। প্রাচীনকালে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধারা সংসারের নানা জ্বালা যন্ত্রনা থেকে মুক্তি বা শান্তির খোঁজ করার জন্য স্ব-ইচ্ছায় তারা সন্যাস প্রথা গ্রহন করে নিত, কিন্তু এখন আধুনিক যুগে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধারা তাদের স্ব-ইচ্ছায় নয়, তারা তাদের সন্তানদের স্ব-ইচ্ছায় অর্থাৎ তাদের সন্তানদের সুখ ও শান্তির জন্য বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সন্তানরাও তাদের বাবা-মায়েদের জোর করেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করাচ্ছেন। এই বিষয়টাতে আমরা আধুনিক সন্তানদের নৈতিক জ্ঞানশূন্যতা, স্বার্থপরতা ও মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয় কি পাই না?
তদের বাবা-মায়েরা যখন কর্মক্ষম ছিলেন, তখন তারা উপার্জন করে নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতেন। কিন্তু আজ বাবা-মায়েরা যখন তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন তখন কিছু কিছু নৈতিক জ্ঞানশূন্য সন্তানরাই তাদের বাবা-মায়ের মুখে অন্ন তুলে না দিয়ে তাদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু তাই নয়, যে বাবা-মা তাদের আপদে, বিপদে ও দুঃখের দিনের একমাত্র পাশে ছিলেন, সকলের থেকে ছিলেন প্রিয় আপনজন। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো তাদের মাথার ওপর আশ্রয় দাতা হিসাবে ছিলেন। আজ সেই বৃক্ষরূপী বটগাছকেই কিছু কিছু নৈতিক জ্ঞানশূন্য সন্তান সেই স্থান থেকে উপড়ে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দিচ্ছেন। বৃক্ষরূপী সেই বাবা-মায়েরাই আজ হয়ে গেলেন আশ্রয়হীন। তারা তাদের সন্তানদের কাছে হয়ে উঠলেন 'আস্তাকুঁড়ের এঁটোপাতা'। তারা এখন তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে সংসারের বোঝা হয়ে আছেন। তাদের সন্তান থেকেও আজ তারা নিঃসন্তান ও অসহায়। সন্তানদের সেবা যত্ন পাওয়া তো দূরের কথা, তারা তাদের মুখ দর্শনও করতে পারেন না। তাদের জীবনের শেষ অধ্যায় অতিবাহিত হয় বার্ধক্যের যন্ত্রনায়। বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের বিছানায় আয়াদের দ্বারা অনেক দুঃখ কষ্টে কোনরকমে দিন অতিবাহিত করেন। তাইতো এই সবকিছুর প্রতিফলন আমরা শুনতে পাই নচিকেতার কণ্ঠে-
"ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার,
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার,
নানারকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি"।
এসবের মূল কারণ হল নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। কৃত্রিম স্বার্থসর্বস্ব জীবনে সবকিছুরই মূল্য নির্ধারিত হয় অর্থের নিরিখে। তাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থা শোচনীয় হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাই আজ খুবই প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার। মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক বন্ধনের দৃঢ়তা, নৈকট্য ও আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সমস্যাকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে মানবিকতার খাতিরে তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সমাজে উপযুক্ত স্থান দিতে পারলে সামাজিক শিষ্টাচার ও সামাজিক মেলবন্ধন অটুট থাকবে, তবেই তাদের শ্রম ও স্বপ্নের যথোপযুক্ত সম্মান আমরা দিতে পারবো।
সংশ্লিষ্ট পোস্ট

আমার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হলেন জ্ঞান ও বোধ। তোমাদের আঁচলে কি ? কি বাঁধা আছে ? জ্ঞান ও বোধ বেঁধে রেখেছো কেন ? আঁচলে চাবি গোছা।তার সাথে রবীন্দ্রনাথ।সকল মায়ের আঁচলে বাঁধা।সন্তান ছুটতে ছুটতে চলে এল।চোখে ঘাম।মুখে ঘাম।পায়ে ধুলা।ছেলে মেয়ের পৃথক গামছা।গামছায় ছেলে মেয়ে পরিস্কার হল। মা ওদের তো রবীন্দ্রনাথ দিলে না ? রবীন্দ্রনাথ গামছায় নেই।রবী আছেন আঁচলে।

রঞ্জিত কথা - শঙ্খ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি-র সেই কথা মনে পড়ে –‘আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে’। সেই অন্ধকারে এঁকে রাখা ছবিগুলো যা রঞ্জিত সিংহ’র ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থেকে গিয়েছিলো, আমি সেগুলোকেই আলোয় আনতে চেয়েছি। ‘রঞ্জিতকথা’ তাই।

গাছ
চুপ করে বসে থাক আর শোন। গাছেরাও কথা বলে জানলাম কাল। সকালে হাই তোলার মত করে গাছেরাও শব্দ করে শুকনো,ভেজা পাতাগুলোকে ঝেড়ে ফ্যালে সকালের প্রথম হাওয়ায়। তারপর একটু হাত পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করে, সকালের রোদে। শুকনো ডালগুলোর মড়মড় আওয়াজ শুনলে বুঝবি।