
অকৃতদার সেজো কাকা যখন পথ থেকে এক অচেনা পনের-ষোল বছরের মেয়েকে ঘরে এনে তুললেন তখন বাড়ির সবাই অবাক হয়ে গেলেন! আমার দাদি ছিল সেকেলে মানুষ। তাই হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এই পরিচয়হীন মেয়েকে দেখে উনি বেশ বিরক্ত হলেন। কিন্তু তিনি সেটা কাউকে বুঝতে দিলেন না। আমি ছোট থেকেই দেখেছি দাদির স্নেহ এই সেজো কাকার প্রতি একটু বেশিই ছিল। হয়তো বিয়ে করেননি বা সংসার হয়নি বলেই দাদি সেজো কাকাকে এতটা ভালবাসতেন। যাইহোক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়েটি সংসারের সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠল। প্রতিটি কাজে, আনন্দ উৎসবে সে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকলো। তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি যে, সে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। বছর দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে বড়দের ফিসফিসানিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কী, কেন শুনতে শুনতে কান খাড়া করে যা শুনলাম, তা শিউরে ওঠার মতো। সেজো কাকার আনা সেই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটি নাকি সন্তান সম্ভবা! আমি তখন বেশ ছোটো, নয় কিংবা দশ। সবটা বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝেছি, ওই মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে ঘোরোতর কিছু একটা বিপর্যয় ঘটেছে। যদিও সেই বিপর্যয়ের পরিমাণ কতটা তা মাপার ক্ষমতা আমার ছিল না। ফলে ব্যাপারটার গভীরতা উপলব্ধি করতে না পেরে একটা সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম বাড়িতে সবাই চুপচাপ। একটা থমথমে পরিবেশ। মেয়েটিকেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না! অন্যদিকে সেজো কাকা আমাদের লম্বা বারান্দার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত উত্তেজিতভাবে হেঁটে চলেছেন আর মনে মনে কী যেন বিড়বিড় করে বলছেন। দাদি তাকে প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “ সতু, রাগ করিস না বাবা। একটু শান্ত হ। ব্যাটাছেলেদের একটু আধটু ভুল হতেই পারে। তুই বাড়ি ছেড়ে চলে যাস না খোকা।” কিন্তু সেজো কাকা কোন কথাই শুনতে চান নি। উনি চিরকাল একটু একরোখা এবং নীতিনিষ্ঠ। সেই যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন আর কখনো ফিরলেন না! সেই শোকে কিনা জানিনা দাদিও বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। পরে জেনেছিলাম, ওই মেয়েটির সর্বনাশের জন্য আমার বাবাই দায়ী। আমি বিস্মিত এবং অবাক হয়ে গেলাম। যে বাবাকে প্রতিনিয়ত দেখেছি ঈশ্বরের আরাধনা করতে,কণ্ঠীর মালা জপতে,পাপ থেকে শত হস্ত দূরে থাকার জন্য ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে।সেই বাবা কিনা এই কাজ করলেন! এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব স্মৃতি ফিকে হয়ে গেল। আমাদের সংসারও ভুলে গেল সেজো কাকা এবং তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া সেই মেয়েটিকে। আমিও পড়াশোনার জন্য দিল্লিতে চলে এলাম। একদিন কলেজ থেকে ফিরছি, প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ রাস্তার উল্টোদিকে নজর পড়তে আমার চোখ দুটো বিস্ময়ে আটকে গেল…”আরে, সেজো কাকার সেই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটি না!” মলিন চেহারা, ততোধিক মলিন তার পরিহিত পোশাক। হাতে কয়েক গাছা রজনীগন্ধার মালা। সঙ্গে দশ- এগারো বছরের একটি বাচ্চা। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে ফুলের মালা নেওয়ার অনুরোধ করছে। কেউ নিচ্ছেন, কেউ নিচ্ছে না। একটা সময় সে আমার গাড়ির জানালার কাছে এসে দাঁড়াল,“একটা মালা নেবেন দিদিমণি?” সেই একই কন্ঠস্বর! একটু চাপা হাস্কি। চেহারাটা বুড়িয়ে গেলেও মুখের আদলটার কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রথম যেদিন সেজো কাকা মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে এনেছিলেন সেই মায়াময় দেহবল্লরীর অনেকটাই আজ ক্ষয়িষ্ণু। এগুলো নিয়ে যখন ভাবছি হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো সেই বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি।–“এ আমি কী দেখছি! একই মুখ! সঙ্গে চিবুকের নিচে ছোট্ট একটা তিল। ওই তিলটি অবিকল আমার বাবার গালেও দেখেছি!” আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি শিমুল দিদি না!?” মেয়েটি বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মতো গাড়ির কাছ থেকে ছিটকে সরে গেল। আমি জানালা থেকে মুখ বার করে বললাম, ”তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি শিমুলদি তুমি যেও না, দাঁড়াও।” ঠিক সেই সময় সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল। পিছনে হর্নের আওয়াজ আর চিৎকারে আমার ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। দিল্লির বিশাল জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া শিমুলদি ও তার সন্তান আবারও হারিয়ে গেল। কিন্তু রেখে গেল একরাশ প্রশ্ন ও কৌতুহল।
এরপর বেশ কয়েকবার কলেজ থেকে মেসে ফেরার পথে এই জায়গায় নেমে আমি ওদের অনেক খুঁজেছি। কিন্তু শিমুলদি ও তার সঙ্গের বাচ্চাটির আর কোন খোঁজ পাইনি। দেখা করাটা যে কি ভীষণ জরুরী, তা ও জানে না! দেখা হলে বলতাম,..... “তোমার কিসের লজ্জা শিমুলদি? তুমিই তো মাথা উঁচু করে চলবে! যারা সন্তানের পিতা হয়েও দায় স্বীকার করে না তারাই তো পতিতা। যে সমাজ, যে সংসার তোমার মতো মায়ের দিকে আঙুল তোলে; সেই সংসার, সেই সমাজই তো পতিতা। মহাভারতের কুন্তী সমাজ সংসারের ভয়ে সন্তান ত্যাগ করলেও তিনি সতী! অথচ তুমি সমাজ সংসারের সমস্ত চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তিল তিল করে নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে এই মুক্ত পৃথিবীর আলো দেখিয়েছ, নব জীবনের জয়গান গেয়েছ… সেই তুমি সতী নও? তুমি তো এ যুগের জানকী। যাকে সতীত্বের পরিচয় দিতে বারংবার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তুমি নও, লজ্জা পাওয়া উচিত আমার, আমাদের, এ সমাজের। যারা সমস্ত দায়ভার তোমার উপর চাপিয়ে সে রাত্রে তোমাকে আর তোমার আনাগত সন্তানকে গৃহছাড়া করেছিল।”
সংশ্লিষ্ট পোস্ট

সোয়েটার
গন গনে নীল শিখা মেলে গ্যাসের উনুন জ্বলছে। কেটলিতে জল সেই কখন থেকে ফুটে চলেছে। বাষ্প হয়ে অর্ধেক জল মরে গেছে। সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই নীলার। সে একটা বেতের গদি মোড়া আরাম চেয়ারে বসে আছে। কিচেনটা ঢের বড়। প্রায় প্রমাণ সাইজ একটা ঘরের মতো। এখানে বসে উলের কাঁটায় শব্দ তুলে সোয়েটার বুনে যাওয়া তার একমাত্র বিলাসিতা। শীতের দিনে আগুনের এই উত্তাপটা কী যে আরামের, নীলা তা কাউকে বোঝাতে পারবে না। গ্যাসটা কতক্ষণ জ্বলছে সে দিকে তার কোনও খেয়াল নেই। চায়ের জল বসানোটা আসলে একটা ছুতো। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতাকে সে প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিচ্ছে। গ্যাস পুড়ছে পুড়ুক। সেই নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার স্বামী বিপুলের টাকার অভাব নেই। তারা বিশাল ধনী না হতে পারে কিন্তু এই সব সামান্য বে-হিসেবী খরচ করার মতো তাদের ঢের পয়সা আছে।

এখানে আসবে না কেউ
চেক - হ্যালো টেস্টিং - শুনতে পাচ্ছেন? শুনুন – জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে গেল। ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। দেওয়ালে ঘষটানির একটা শব্দ। পুরোনো বছর উড়ছে। আমি ৩১শে ডিসেম্বরে এসেই থমকে গেছি। বাইরে নতুন বছর চলছে, আমি পুরোনো বছরে। কীরকম অদ্ভুত লাগে। কাকতালীয় ভাবে দেওয়াল ঘড়িটাও বন্ধ। ব্যাটারি শেষ।

অবনী বাড়ি আছো
“আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া ‘অবনী বাড়ি আছ?”