
শো
অল্প দূরে, হয়তো বাড়ি থেকে দুই এক কিমি, বান্ধের পাড়। একটা শো শো আওয়াজ, কেমন একটা রহস্যময়ী, বিশেষ করে বেলা বয়ে যাওয়া বিকেলে, সাঁঝের মুখে। প্রায় প্রতিদিন শুনতে পেতাম। ইচ্ছে হত ছোটোবেলায়, একদিন যাব দেখতে কোথাত্থেকে আসে সে। যদিও ছোটোবেলায় যাওয়া আর হয়নি। একবার তহি চাচার বিয়েতে গেছিলাম, বয়স যে তখন কত হবে কে জানে, শুনেছিলাম ওরই কাছাকাছি বাঁধের পাড়। যখন বড়ো হয়ে গেছিলাম হয়তো কোনোদিন ততদিনে সে ভয়ানক মোহময়ী আওয়াজ হারিয়ে ফেলেছে তার গলা। শুকনো সে বাঁধ। ভাঙা। নদীটার নাম বুড়ি তোর্সা, তার থেকে খাল কেটে যেটা এসেছিল, লোকে বলে যাম্পই্। আগে একটা লকগেট টাইপের ছিল, বাচ্চা, ওই দিয়েই সে শো শো। এক্ষণে ল্যাপটপটা ওরকম শো শো। যদিও সে আওয়াজে সে টান পাচ্ছি না, হয়তো ওর নিজের কোনো আকর্ষণী ক্ষমতা নেই তেমন, নতুবা আমার নিজেরই সাধ্য নেই সে ধরার। উপলব্ধিগুলো তো দিনকে দিন ভোঁতাটে। মগজে শান পড়ে না। ঘিলু শুকিয়ে শুষ্ক খড়খড়ে। তরুবরের যাবতীয় ইন্দ্রিয়টিন্দ্রীয়গুলো অকেজো অকেজো। তবু একটা হস্তীর পদধ্বনি কোথাও। শুনতে পাচ্ছি, নিস্তরঙ্গ আওয়াজ, পুরো দস্তুর নয়েজ ক্যানসেলেশন সেরে সে এদিকে। ভূপেন হাজারিকা গাইত ‘পদধ্বনি শুনি’। নূপুর পায়ে পরা না থাকলেও পদধ্বনি ঠিকঠাক। যদিও শেকলকে শোভা বানিয়ে ও পরে। ওকে পরায়, বাধ্য করে। কোনো মাহুত। মাহুত মানে মানুষ। গণতন্ত্রের পাঠ এখানটায় ওরকম।
এ সময় টিং টং মেসেজ আসছে না, নোটিফিকেশন। আসছে ঠিক। শোনা যাচ্ছে না মাত্র। মিউট বা মূক হয়ে আছে কাছের ফোনমানুষীটি। হয়তো বিস্তর জমেছে, জমছে ওর কাছে এসে কথা, বার্তারা। ওখানে নাকি হোয়াটস্যাপ নামের ভার্সিটিও আছে এক। তাতে ভুজুংভাজুং সব কারবার চলে। এ অবশ্য কোনো এক পক্ষের কথা। কোনো আরেক পক্ষের কথা হয়তো আর এক। থাক এগুলা। এসব টপিক ভাল্লাগে না। ভাল্লাগার জিনিসটা কী ইদানীং, তার হদিশও অজানা অবশ্য। অনেকক্ষণ থেকেই (হয়তো) আমি ভাবছি আরেক কথা। হস্তীর পা। হাত্তির পায়ের ছাপ। যে-ছাপ ধরে ছাপ্পা ভোটে তো নয়, অন্য কোথা যাওয়ার। লোকে যাক গা যেদিক খুশি। বুঝুক গা তারাই। আমিও বুঝে নিই আমারটা। যদিও সমস্যা হলো গিয়ে বুঝে নেওয়ার আগে, আমার অস্তিত্বটাই আমার বোঝা বাকি অনেক। টিপ দেবার মতন, কান্নার ইমুজি নেই বলে এখানে একটা তা দিতাম ভেবেও, দিতে পারছি না।
অল্পই দূর, কাছেই। কান্না ভেসে এল কারোর। পড়শি ভাবি, বাবুলদার বউ এসে মাকে আম্মা আম্মা করে ডেকেও আম্মার সাড়া পেল না। সদ্যই আজ এনে দিয়েছিলাম মাকে ঘুমের বড়ি। ভাবির হাঁকডাকে বাড়িভর্তি কুকুরের হাউমাউ উঠল। বেরিয়ে জিজ্ঞেস করতে শুনলাম, ফুফু মারা গেল। মারা গেছে। হায় স্মৃতি। ফুফুর কথা বললেই, ধাপাউ ফুফার নাম চট করে মনে পড়ে। নাম মানে আসলে নাম নয় অবশ্য। মানুষ। জিন্দা। আসল নাম আব্দুল জব্বার। বিচিত্র এক মানুষ ছিলেন। দেশীয় ভাষায় শশব্যস্ত মানুষকে বলত ধাপাউ, তেমনটাই ছিলেন। ফুফুর নাম কী? কী ছিল? মনে পড়ছে না। মনে হলো আমার মাথায় মুণ্ডুহীন ভুট্টা, ভুট্টার গাছের কথা এতক্ষণে, কোনো ফাঁক বুঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল কেন যেন। সেটা আচমকাই নিঃসাড়। ল্যাপটপের শো শোটাই কেবল বেঁচে। যেটা অনেক যুগ ধরে চলছিল, কিন্তু যা ক্রমাগত মনে হয়নি আমার। এবারে ও পুনরায় টের পাওয়া।
সংশ্লিষ্ট পোস্ট

সোয়েটার
গন গনে নীল শিখা মেলে গ্যাসের উনুন জ্বলছে। কেটলিতে জল সেই কখন থেকে ফুটে চলেছে। বাষ্প হয়ে অর্ধেক জল মরে গেছে। সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই নীলার। সে একটা বেতের গদি মোড়া আরাম চেয়ারে বসে আছে। কিচেনটা ঢের বড়। প্রায় প্রমাণ সাইজ একটা ঘরের মতো। এখানে বসে উলের কাঁটায় শব্দ তুলে সোয়েটার বুনে যাওয়া তার একমাত্র বিলাসিতা। শীতের দিনে আগুনের এই উত্তাপটা কী যে আরামের, নীলা তা কাউকে বোঝাতে পারবে না। গ্যাসটা কতক্ষণ জ্বলছে সে দিকে তার কোনও খেয়াল নেই। চায়ের জল বসানোটা আসলে একটা ছুতো। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতাকে সে প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিচ্ছে। গ্যাস পুড়ছে পুড়ুক। সেই নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। তার স্বামী বিপুলের টাকার অভাব নেই। তারা বিশাল ধনী না হতে পারে কিন্তু এই সব সামান্য বে-হিসেবী খরচ করার মতো তাদের ঢের পয়সা আছে।

এখানে আসবে না কেউ
চেক - হ্যালো টেস্টিং - শুনতে পাচ্ছেন? শুনুন – জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে গেল। ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। দেওয়ালে ঘষটানির একটা শব্দ। পুরোনো বছর উড়ছে। আমি ৩১শে ডিসেম্বরে এসেই থমকে গেছি। বাইরে নতুন বছর চলছে, আমি পুরোনো বছরে। কীরকম অদ্ভুত লাগে। কাকতালীয় ভাবে দেওয়াল ঘড়িটাও বন্ধ। ব্যাটারি শেষ।

অবনী বাড়ি আছো
“আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া ‘অবনী বাড়ি আছ?”